বান্দরবান জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত একটি পার্বত্য জেলা, যা তার অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য পরিচিত।

নামকরণের কিংবদন্তি
বান্দরবান নামকরণের পেছনে একটি জনপ্রিয় কিংবদন্তি রয়েছে। প্রাচীনকালে, এই অঞ্চলে অসংখ্য বানর বসবাস করত। তারা শহরের প্রবেশমুখে ছড়ার পাড়ে পাহাড়ে লবণ খেতে আসত। এক সময় অনবরত বৃষ্টির কারণে ছড়ার পানি বৃদ্ধি পেলে, বানরের দল একে অপরকে ধরে ধরে সারিবদ্ধভাবে ছড়া পার হতো। এই দৃশ্য দেখে স্থানীয়রা এলাকাটিকে “ম্যাঅকছি ছড়া” নামে ডাকতে শুরু করে, যেখানে মারমা ভাষায় “ম্যাঅক” অর্থ বানর এবং “ছি” অর্থ বাঁধ। কালের পরিক্রমায় এই নামটি পরিবর্তিত হয়ে “বান্দরবান” হয়েছে। বর্তমানে সরকারি দলিলপত্রে এই নামটি স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। তবে মারমা ভাষায় বান্দরবানের নাম “রদ ক্যওচি ম্রো”।
প্রশাসনিক ইতিহাস
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে জেলা ঘোষণা করা হয়, যার অধীনে বান্দরবান ছিল। ১৮৬৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সুপারিনটেনডেন্ট পদটির নাম পরিবর্তন করে ডেপুটি কমিশনার করা হয়। প্রথম ডেপুটি কমিশনার ছিলেন টি. এইচ. লুইন। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন অনুসারে, পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়: চাকমা সার্কেল, মং সার্কেল এবং বোমাং সার্কেল। বান্দরবান বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত ছিল, যার ফলে এ জেলার আদি নাম ছিল “বোমাং থং”। ১৯৫১ সালে বান্দরবান মহকুমা হিসেবে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু করে এবং ১৯৮১ সালের ১৮ এপ্রিল সাতটি উপজেলার সমন্বয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূপ্রকৃতি
বান্দরবান জেলা ২১°১১´ থেকে ২২°২২´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°০৪´ থেকে ৯২°৪১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এ জেলার উত্তরে রাঙ্গামাটি জেলা, দক্ষিণে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য, পূর্বে রাঙ্গামাটি জেলা ও মিয়ানমারের চিন রাজ্য, পশ্চিমে কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রাম জেলা।
জেলার মোট আয়তন ৪,৪৭৯.০২ বর্গ কিলোমিটার। এখানে প্রধান গিরি শ্রেণীর মধ্যে মিরিঞ্জা, ওয়ালটং, তামবাং এবং পলিতাই উল্লেখযোগ্য। পাহাড়গুলো সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৩০০ থেকে ১,১০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এ অঞ্চলের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ, যেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বার্ষিক বৃষ্টিপাত প্রায় ৩,০৩১ মিলিমিটার। প্রধান নদীগুলোর মধ্যে সাঙ্গু, মাতামুহুরী এবং বাঁকখালী উল্লেখযোগ্য।
জনসংখ্যা ও সংস্কৃতি
বান্দরবান জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৪,০৪,০৯৩ জন। এখানে বিভিন্ন উপজাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে, যেমন: মারমা, ত্রিপুরা, চাকমা, বম, মুরং, খিয়াং, খুমী, লুসাই, পাংখোয়া, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক ও ম্রো।
প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক ও উৎসব রয়েছে। মারমা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, নৃত্য ও সঙ্গীত রয়েছে এবং তারা বিভিন্ন উৎসব পালন করে।

বান্দরবান জেলা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এ জেলার পাহাড়, নদী, বন এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সহাবস্থান একে একটি অনন্য ভূখণ্ডে পরিণত করেছে।
আরও পড়ুনঃ

১ thought on “বান্দরবান জেলার ভৌগলিক পরিচিতি”