বান্দরবান শুধু নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং এখানকার বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি খাবারও বাংলাদেশি রসনার জগতে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, মুরং, খিয়াংসহ বিভিন্ন পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব রান্নার ধারা, মসলা ব্যবহারের বৈচিত্র্য, এবং অরগানিক উপাদানের প্রাচুর্য বান্দরবানের খাবারকে করে তুলেছে অনন্য ও স্বাস্থ্যসম্মত।

🍲 ১. বাজি / ভর্তা (Bamboo Shoot Curry / Bharta)
‘বাজি’ বা বাঁশ কচি দিয়ে তৈরি তরকারি বান্দরবানের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। এটি বাঁশের চারা কুচি করে রান্না করা হয় শুকনো চিংড়ি, পাহাড়ি লঙ্কা এবং সরিষার তেলে।
স্বাদ ও বৈশিষ্ট্য:
স্বাদে একটু তেঁতো-মশলাদার, হালকা টক ভাব
খুব স্বাস্থ্যকর ও হজমে সহায়ক
পরিবেশন:
গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশিত হয়
কখনও কখনও মুরগি বা শুকরের মাংস দিয়ে মিশ্রিতও করা হয়
🍚 ২. পাহাড়ি হাড়ি ভাত (Sticky Rice)
বান্দরবানের উপজাতিদের একটি প্রধান খাবার হল বাঁশের খোলসে রান্না করা হাড়ি ভাত বা বাঁশ ভাত। এটা সাধারণ চাল নয়, বরং কিছুটা আঠালো রকমের চালে তৈরি হয়।
রান্নার ধরন:
চালকে বাঁশের খোলসে ভরে আগুনে পুড়িয়ে রান্না করা হয়
এতে ভাতের মাঝে একটি ধোঁয়াটে সুগন্ধ তৈরি হয়
🍛 ৩. শুকরের মাংস (Pork Curry)
মারমা, ত্রিপুরা, মুরং ইত্যাদি উপজাতিদের মাঝে শুকরের মাংস একটি জনপ্রিয় খাবার। সাধারণত বিশেষ উপলক্ষে বা উৎসবে পরিবেশিত হয়।
রান্নার বৈশিষ্ট্য:
শুকরের মাংস হাড়সহ ছোট ছোট টুকরো করে কাটা হয়
আদা, রসুন, পাহাড়ি লঙ্কা, বাঁশ কচি, লালচে ঘন ঝোল – এ সবই থাকে এতে
অনেক সময় শুকানো ধনেপাতা ও গাছবিচালি দিয়ে রান্না করা হয়
🍲 ৪. পাহাড়ি সূপ (Pahari Soup / Chicken Bamboo Soup)
দেশি মুরগি, বাঁশকচি, আদা, রসুন, পেঁয়াজপাতা, লবণ এবং ঘরোয়া মশলা
বৈশিষ্ট্য:
স্বাদে হালকা ঝাঁজযুক্ত ও উষ্ণতা-বর্ধক
শরীরের জন্য উপকারী, বিশেষত ঠান্ডার সময়
🌶️ ৫. জাল খাও (Jhal Khaw)
এটি একটি মারমা তরকারি যা বিভিন্ন পাতা, শাক-সবজি, শুকনা চিংড়ি এবং ঝাল দিয়ে তৈরি হয়।
স্বাদ:
মসলা কম, ঝাল বেশি
স্বাদে টক ও হালকা তেতো
🥬 ৬. কাঁচা পাতা দিয়ে রান্না (Mixed Leaf Curry)
উপাদান:
মিস্টি পাত, শিমপাতা, আলুর পাতা, সাগা পাতা ইত্যাদি
বিশেষত্ব:
উপাদানগুলো অনেক সময় গাঁথুনির মত করে বানানো হয়
এতে অনেকটা ভর্তার মতো করে পরিবেশন করা হয় ভাতের সঙ্গে
🐟 ৭. পাহাড়ি মাছের ঝোল (Hill Fish Curry)
বান্দরবানের নদী ও ঝিরি-নালার দেশি মাছ যেমন — তিলা মাছ, গজার, শোল, বাইম ইত্যাদি দিয়ে রান্না করা হয় বিশেষ ঝোল।
বৈশিষ্ট্য:
রান্নায় তেল কম, কাঁচামরিচ বেশি
আদা, বাশ কচি, পেঁয়াজপাতা ব্যবহার করা হয়
🍌 ৮. কাঁঠাল বীজ ভাজি / কলার মোচা ভর্তা
খাদ্য সংস্কৃতি:
পাহাড়িদের রুটিন খাদ্যে সবজি অনেকটা ভর্তা বা শুঁটকি ভর্তার মতো করে খাওয়া হয়। কলার মোচা দিয়ে বানানো ঝাল ভর্তা, কাঁঠালের বিচি ভাজা — এইসব পাহাড়ি পদ খুব জনপ্রিয়।
🍢 ৯. পাহাড়ি শুঁটকি ভর্তা (Dry Fish Bharta)
স্বাদ:
ঝাঁজালো, ঘ্রাণযুক্ত কিন্তু রসনাসুখদায়ক
আদা, রসুন, কাঁচামরিচ, সরিষার তেল দিয়ে তৈরি
🍲 ১০. “আঙ্গুই” বা লতাপাতা স্যুপ
উপজাতিরা বিশেষত “আঙ্গুই” নামক একটি পাহাড়ি লতা পাতা ব্যবহার করে রাঁধে একধরনের স্যুপ। এটি শরীর ঠান্ডা রাখতে সহায়তা করে এবং স্বাদে কড়া।
🍵 ১১. পাহাড়ি চা ও হ্যান্ডমেড কফি
বান্দরবানে কিছু কফি ও চায়ের ছোট খামার রয়েছে, বিশেষত থানচি ও রুমার পাহাড়ি এলাকা ঘেঁষে। এখানকার চা ও কফি মৃদু সুগন্ধি ও অর্গানিক গুণসম্পন্ন।
🍰 ১২. পাহাড়ি মিষ্টান্ন ও কেক
অনেক উপজাতি ঘরে তৈরির জন্য চালের গুঁড়া, নারকেল ও গুড় দিয়ে তৈরি করে পাহাড়ি কেক বা মিষ্টান্ন। কিছুটা ‘পিঠার’ মতো স্বাদ হলেও পরিবেশনা ও গঠন আলাদা।
বান্দরবানের খাবার শুধু স্বাদে নয়, বরং এটি ঐতিহ্য, পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির এক অনবদ্য মিশ্রণ। যারা ভ্রমণপ্রিয় এবং ভিন্নধর্মী রন্ধনপ্রণালির স্বাদ নিতে চান, তাদের জন্য বান্দরবানের খাবার হতে পারে এক স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা।
আপনি যদি কখনো বান্দরবানে ভ্রমণে যান, তবে কেবল প্রকৃতি নয়, সেখানকার রান্নাঘরের ধোঁয়াটে ঘ্রাণেও ডুবে যেতে ভুলবেন না!

১ thought on “বান্দরবান জেলার বিখ্যাত খাবার”