বান্দরবান জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বান্দরবান জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য যেমন খ্যাতি অর্জন করেছে, তেমনি এই জেলার কিছু কৃতী সন্তান বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, ক্রীড়া ও সমাজে অনন্য ভূমিকা রেখে গেছেন। এই নিবন্ধে আমরা তিনজন বিশিষ্ট বান্দরবানবাসীর কথা জানবো যাঁদের জীবন, সংগ্রাম এবং অর্জন শুধু জেলার গর্ব নয়, বরং গোটা বাংলাদেশের জন্যই এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

বান্দরবান জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি:

বান্দরবান জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি
বীর বিক্রম ইউ. কে. চিং

 

🛡️ বীর বিক্রম ইউ. কে. চিং: পার্বত্য চট্টগ্রামের গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা

টাইমলাইন:

  • ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, ৮ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন।

  • পরবর্তীকাল: ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হন।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতার জন্য জীবনপণ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বীর সন্তান ইউ. কে. চিং। একজন আদিবাসী হয়েও বাংলা মায়ের টানে তিনি অস্ত্র হাতে তুলে নেন, বাঙালি ভাইদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেন।

ইপিআর (বর্তমান বিজিবি)-এর একজন সদস্য হিসেবে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করেন। তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। তিনি একমাত্র আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা যিনি রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত, যা তাঁকে বান্দরবান জেলার ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

 

⚽ জাফর ইকবাল: বান্দরবান থেকে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে

টাইমলাইন:

  • ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯: বান্দরবানে জন্মগ্রহণ।

  • ২০১৬: আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের হয়ে অভিষেক।

  • ২০১৮: জাতীয় দলের হয়ে প্রথম গোল করেন (লাওসের বিরুদ্ধে)।

বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে যে কয়জন তরুণ প্রতিভা বান্দরবানকে গর্বিত করেছে, জাফর ইকবাল তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাঁ পায়ের দুর্দান্ত পারফর্মেন্স ও স্পিডে সমৃদ্ধ এই আক্রমণভাগের খেলোয়াড় আরামবাগ, চট্টগ্রাম আবাহনী, সাইফ স্পোর্টিং এবং বর্তমানে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন।

জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক অভিষেক এবং এরপর বয়সভিত্তিক দলসহ সিনিয়র জাতীয় দলে নিয়মিত অংশগ্রহণ তাঁর অসাধারণ ফুটবল প্রতিভারই প্রমাণ। ভারতের বিপক্ষে অনূর্ধ্ব-২০ দলে অভিষেক ম্যাচেই গোল করার কৃতিত্ব তাঁর ক্যারিয়ারকে আলাদা করে তোলে।

জাফর ইকবাল (ফুটবলার)

 

বীর বাহাদুর উশৈ সিং, রাজনীতিবিদ
বীর বাহাদুর উশৈ সিং, রাজনীতিবিদ

 

 

বীর বাহাদুর উশৈ সিং, রাজনীতিবিদ

বীর বাহাদুর ঊশৈসিং একজন প্রজ্ঞাবান, পরিশ্রমী ও জনদরদী রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯৬০ সালের ১০ জানুয়ারি বান্দরবান পার্বত্য জেলার সদর উপজেলার এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রয়াত লালমোহন বাহাদুর এবং মাতা মা চ য়ই, যিনি একজন গৃহিণী ছিলেন।

প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন ১৯৬৫ সালে। ১৯৭৬ সালে বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং পরে বান্দরবান সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক এবং পরে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি বান্দরবান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সহ-সভাপতির দায়িত্বে নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি জেলা স্কাউট কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন।

২০০২ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের হুইপ নিযুক্ত হন। এই দায়িত্বে থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক কার্যক্রম সুসংহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৯৭ সালে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির আলোচনায় তিনি ছিলেন সরকারের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য। তিনি দুইবার পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন—প্রথমবার উপমন্ত্রীর মর্যাদায় (১৯৯৮) এবং দ্বিতীয়বার প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় (২০০৮)। তাঁর নেতৃত্বে পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগাযোগসহ নানা খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়।

নবম জাতীয় সংসদে তিনি সংসদীয় কমিটির সদস্য ও প্যানেল স্পিকার ছিলেন। ২০১৩ সালের ২২ জুলাই তিনি সংসদের খণ্ডকালীন সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

শিক্ষা ও ক্রীড়ার প্রতিও তাঁর গভীর আগ্রহ রয়েছে। তিনি ১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং বাংলাদেশ ফুটবল রেফারী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০০ সালের অলিম্পিক গেমসে তিনি বাংলাদেশের চীফ অব দ্য মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ বহু দেশে তিনি রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন।

জাতীয় বৃক্ষরোপণে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। ২০১০ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে মনোনীত হন এবং এখনো এই পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

রাজনৈতিক জীবনে বীর বাহাদুর ঊশৈসিং ১৯৯১ সালে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর তিনি পরপর ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হন। ২০১৪ সালে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং ২০১৯ সালে পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় শপথ নেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ১৯৯১ সালে মে হ্লা প্রু-কে বিয়ে করেন। তাঁদের দুই পুত্র ও এক কন্যা রয়েছে। বড় ছেলে উসিং হাই (রবিন) বার-এট-ল-এর শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত, ছোট ছেলে থোয়াইং শৈ ওয়াং (রোমিও) অস্ট্রেলিয়ায় কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ছেন এবং একমাত্র কন্যা ম্যা ম্যা খিং (ভ্যানাস) ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী।

বীর বাহাদুর ঊশৈসিং সততা, নেতৃত্বগুণ ও জনসেবার প্রতীক হয়ে আজও বান্দরবানের জনগণের কাছে অনুপ্রেরণা ও আস্থার বাতিঘর।

 

 

বান্দরবান জেলা শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও নেতৃত্বের এক মহাসমারোহ। ইউ. কে. চিং, জাফর ইকবাল এবং বীর বাহাদুর ঊশৈসিং—তাঁরা প্রত্যেকেই বান্দরবানকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

এই জেলার যুবসমাজ তাঁদের জীবনের অনুপ্রেরণায় গড়ে উঠতে পারে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের সাহসিকতা, অন্যদিকে ফুটবলের প্রতিভা এবং রাজনীতির দক্ষতা—বান্দরবানের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক প্রজ্বলিত পথরেখা।

1 thought on “বান্দরবান জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি”

Leave a Comment