নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বান্দরবান জেলার একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বে সমৃদ্ধ।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিচিতি

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ইউনিয়ন সমূহ
- ১ নং নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন
- ২নং বাইশারী
- ৩নং ঘুমধুম
- ৪নং দোছড়ি
- ৫নং সোনাইছড়ি

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ভৌগোলিক অবস্থান ও সীমানা
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার আয়তন ৪৬৩.৬০ বর্গ কিলোমিটার। এর ভৌগোলিক অবস্থান ২১°১১´ থেকে ২১°৪০´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°০৬´ থেকে ৯২°২৩´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। উত্তরে লামা উপজেলা, দক্ষিণে মায়ানমারের আরাকান রাজ্য, পূর্বে আলীকদম উপজেলা এবং আরাকান রাজ্য, পশ্চিমে উখিয়া, রামু ও চকরিয়া উপজেলা দ্বারা বেষ্টিত। উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বোয়ালখালী নদী।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার প্রশাসনিক কাঠামো
নাইক্ষ্যংছড়ি থানা ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৫ সালে এটিকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়। উপজেলাটি ৫টি ইউনিয়নে বিভক্ত: ঘুমধুম, দোছড়ি, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর, বাইশারী এবং চাকঢালা। প্রতিটি ইউনিয়ন আবার মৌজা ও গ্রামে বিভক্ত।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার জনসংখ্যা ও সামাজিক গঠন
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৬১,৭৮৮ জন; এর মধ্যে পুরুষ ৩১,৩৪৭ জন এবং মহিলা ৩০,৪৪১ জন। ধর্মীয় বিভাজনে মুসলিম ৭৪.৩৩%, বৌদ্ধ ২৩.৩০%, হিন্দু ১.০৭% এবং খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ১.৩০%। এ উপজেলায় মারমা, মুরং, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান
উপজেলায় শিক্ষার হার গড়ে ৩১.৩%। এখানে ১টি ডিগ্রি কলেজ, ৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৪টি কমিউনিটি বিদ্যালয়, ২টি কিন্ডারগার্টেন এবং ৪টি মাদ্রাসা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছালেহ আহমদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নাইক্ষ্যংছড়ি মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় এবং নাইক্ষ্যংছড়ি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য।
সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ৩টি লাইব্রেরি, ১টি অডিটোরিয়াম, ৩টি নাট্যদল, ৩টি মহিলা সংগঠন এবং ৫টি খেলার মাঠ রয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা ও স্যানিটেশন
উপজেলায় ১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং ১টি পশু চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থায় ২০.৪% পরিবার স্বাস্থ্যকর ল্যাট্রিন ব্যবহার করে, ৩৭.৬% পরিবার অস্বাস্থ্যকর ল্যাট্রিন ব্যবহার করে এবং ৪২.০% পরিবারের কোনো ল্যাট্রিন সুবিধা নেই।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অর্থনীতি ও কৃষি
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অর্থনীতি প্রধানত কৃষিনির্ভর। জনগোষ্ঠীর আয়ের উৎস হিসেবে কৃষি ৫১.৯৩%, অকৃষি শ্রমিক ১৩.৩০%, ব্যবসা ৯.৪৪%, চাকরি ১০.৩২% এবং অন্যান্য ১১.৭৬%। প্রধান কৃষি ফসলের মধ্যে ধান, আখ, তিল, তুলা, ভূট্টা, রাবার, তামাক, পান, হলুদ, আদা এবং শাকসবজি উল্লেখযোগ্য। প্রধান ফলফলাদি হলো কলা, কাঁঠাল, আনারস, লেবু এবং পেঁপে।
শিল্প ও কুটিরশিল্পের মধ্যে রাবারশিল্প, তামাকশিল্প, করাতকল, তাঁতশিল্প, কাঠের কাজ, বাঁশ ও বেতের কাজ উল্লেখযোগ্য।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার যোগাযোগ ও অবকাঠামো
উপজেলায় পাকা রাস্তা ২২ কিমি, আধা-পাকা রাস্তা ২৫ কিমি এবং কাঁচা রাস্তা ৩৩ কিমি রয়েছে। প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম মাইক্রোবাস। বান্দরবান-লামা-আলীকদম-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়ক, বান্দরবান-থানচি-আলীকদম-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়ক এবং বান্দরবান-কেরানিহাট-চকরিয়া-রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়ক উল্লেখযোগ্য।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বিদ্যুৎ ও পানীয় জল
উপজেলার সবকটি ইউনিয়ন পল্লিবিদ্যুতায়ন কর্মসূচির আওতাধীন হলেও মাত্র ২২.৯% পরিবারের বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। পানীয়জলের উৎস হিসেবে নলকূপ ৬২.৬%, ট্যাপ ১.৩% এবং অন্যান্য ৩৬.১%।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ২৭টি মসজিদ, ৩টি মন্দির, ১টি গির্জা, ৪টি মঠ, ২৯টি কেয়াং, ৪টি প্যাগোডা এবং ২টি আশ্রম রয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তৎকালীন পাক হানাদার বাহিনী মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় আক্রমণ চালালে নাইক্ষ্যংছড়ির জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো তুমব্রু পাড়া ও সোনাইছড়ি এলাকার ঘটনা, যেখানে পাক সেনারা গণহত্যা ও লুটপাট চালায়। এইসব এলাকায় বহু মানুষ শহীদ হন এবং অসংখ্য নারী নির্যাতনের শিকার হন।
তৎকালীন সময়ে নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে বহু মুক্তিযোদ্ধা মিয়ানমার হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন এবং যুদ্ধের জন্য সংগঠিত হন। অনেকেই স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের সহায়তায় ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
উল্লেখযোগ্য মুক্তিযোদ্ধা এবং স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে গঠিত গেরিলা ইউনিটগুলো সীমান্ত এলাকায় হানাদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখতে কিছু স্মৃতিস্তম্ভ ও স্মারক ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এখনও অনেক ইতিহাস ও সাক্ষ্য দলিল সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দর্শনীয় স্থান
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। সবুজ পাহাড়, নদী, ঝরনা ও বনাঞ্চল এই অঞ্চলকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
তুমব্রু সীমান্ত: মায়ানমার সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলটি তার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে উল্লেখযোগ্য।
ডানকান পাহাড় ও ঝরনা: হাইকিং ও ট্রেকিং প্রেমীদের জন্য এক আদর্শ গন্তব্য।
চাকঢালা রাবার বাগান: রাবার চাষের জন্য বিখ্যাত এলাকা।
নাইক্ষ্যংছড়ি রেস্ট হাউস এলাকা: প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের জন্য জনপ্রিয় স্থান।
মারমা ও মুরং সম্প্রদায়ের বসতিগুলো: এদের সংস্কৃতি, ঘরবাড়ি ও জীবনযাত্রা পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ভাষা ও সংস্কৃতি
এ উপজেলায় বাংলা ভাষার পাশাপাশি মারমা, মুরং, ত্রিপুরা, চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার প্রচলন রয়েছে। আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, উৎসব, গান, নৃত্য ও রীতি-নীতি নাইক্ষ্যংছড়ির সংস্কৃতিকে বৈচিত্র্যময় করেছে।
প্রধান ধর্মীয় উৎসবগুলোর মধ্যে বৌদ্ধদের প্রবারণা পূর্ণিমা, চাকমা মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই জল উৎসব, ঈদ, দুর্গাপূজা ইত্যাদি পালিত হয়।
এছাড়া স্থানীয় বাজার, হাট এবং পাহাড়ি গ্রামে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের দৃশ্য নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সাথে মিশে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা তৈরি করে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অর্থনীতি ও জীবিকা
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। এখানকার মানুষ প্রধানত চাষাবাদ, বনজ সম্পদ আহরণ, পশুপালন এবং সীমিত পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষ প্রচলিত, যেখানে আদিবাসী জনগণ তাদের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে ধান, কুমড়া, মরিচ, আদা, হলুদ, কলা, আনারস ইত্যাদি ফলায়।
এছাড়া সমতল অঞ্চলে ধান, আখ, তামাক, সবজি ও বিভিন্ন ফলমূলের চাষ হয়। রাবার ও বেতের চাষ নাইক্ষ্যংছড়িতে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলেছে।
সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় কিছু মানুষ সীমান্ত বাণিজ্যের সাথে জড়িত। তবে সীমান্ত নিরাপত্তা, মাদক পাচার, অবৈধ অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মাঝে মাঝে বিঘ্নিত হয়।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নারী ও শিশুর জীবনমান
নাইক্ষ্যংছড়িতে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা এখনও উন্নয়নের অনেক পিছনে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে বেশি। পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।
নারীদের মধ্যে এখনও শিক্ষার হার কম, যদিও ইদানীং অনেক পরিবার তাদের কন্যাশিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও ও সরকারি উদ্যোগ নারীদের জীবিকাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও আত্মনির্ভরতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করছে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার শিক্ষা ও জনসচেতনতা
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয় এবং একটি ডিগ্রি কলেজ আছে। তবে এখনো শিক্ষার হার জাতীয় গড়ের তুলনায় কম।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য উপযুক্ত ভাষায় ও সংস্কৃতিভিত্তিক পাঠ্যপুস্তকের অভাব শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষকের স্বল্পতা উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
ইতোমধ্যে কিছু এলাকায় এনজিও এবং সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ানো এবং কমিউনিটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার পরিবেশ ও জলবায়ু
নাইক্ষ্যংছড়ি প্রাকৃতিকভাবে খুবই সমৃদ্ধ। পাহাড়, বন, ঝরনা ও নদী এই অঞ্চলকে জলবায়ু ও পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
তবে অতি মাত্রায় জুম চাষ, পাহাড় কাটার প্রবণতা, রাবার বাগান সম্প্রসারণ এবং বনাঞ্চলের অনিয়ন্ত্রিত উজাড় পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে বন্যা, ভূমিধস ও খরা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্থানীয় জনগণকে পরিবেশ সুরক্ষা ও বন সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতন করা জরুরি। একইসাথে পরিবেশবান্ধব কৃষি, সামাজিক বনায়ন, পাহাড় ব্যবস্থাপনা এবং পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন—ভূমিধস, অতিবৃষ্টি, পাহাড় ধস, খরা, ঝড় ইত্যাদির ঝুঁকিতে রয়েছে।
বর্ষাকালে অনেক রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট দেখা দেয়।
সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে কমিউনিটি পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভবিষ্যতে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত সাড়া-দাতা দল (Rescue Team), পর্যাপ্ত খাদ্য ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মজুদ, এবং পাহাড়ি জনপদে বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার পর্যটন সম্ভাবনা
নাইক্ষ্যংছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও আদিবাসী সংস্কৃতি একে একটি পর্যটন সম্ভাবনাময় অঞ্চলে পরিণত করেছে।
প্রাকৃতিক ঝরনা, পাহাড়ি ট্রেইল, রাবার বাগান, আদিবাসী গ্রাম, স্থানীয় হাট-বাজার এবং সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চল পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
পর্যটনের উন্নয়নে স্থানীয় গাইড প্রশিক্ষণ, হোম-স্টে ব্যবস্থা, পর্যটন মানচিত্র, নিরাপদ যাতায়াত এবং পরিবেশ-সচেতন পর্যটন ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার উন্নয়ন সম্ভাবনা
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বহুমাত্রিক প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদ একে একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চলে পরিণত করেছে। উন্নয়নের সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই অঞ্চল একটি উদাহরণ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা – রাবার, আদা, হলুদ, আনারস, কলা, মৌচাষ ইত্যাদি কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলা গেলে কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধি পাবে।
টেকসই পর্যটন উন্নয়ন – স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে পরিবেশবান্ধব পর্যটন গড়ে তুললে আয়, সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বৈদেশিক পর্যটকের আগমন সম্ভব।
সীমান্ত বাণিজ্য – সীমান্তে বৈধ ট্রানজিট হাব ও লজিস্টিক সেন্টার গড়ে তুলে বৈধ ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
হস্তশিল্প ও আদিবাসী সংস্কৃতি – আদিবাসীদের বোনা কাপড়, বাঁশ-বেতের সামগ্রী, ঐতিহ্যবাহী গান ও নৃত্য বিকাশে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
শিক্ষা ও আইসিটি – ডিজিটাল শিক্ষা ও কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার তৈরি করে তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার উন্নয়ন প্রতিবন্ধকতা
নানা সম্ভাবনার মধ্যেও নাইক্ষ্যংছড়ির উন্নয়নপ্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো:
যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল – দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নত নয়। বর্ষায় অনেক রাস্তাঘাট অচল হয়ে পড়ে।
সীমান্ত সমস্যা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি – মাদক পাচার, সীমান্ত উত্তেজনা ও চোরাচালানের কারণে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো দুর্বল – শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও মান অপর্যাপ্ত। চিকিৎসা কেন্দ্র কম, এবং চিকিৎসক সংকট রয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি – পাহাড় ধস, বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় প্রায় প্রতি বছর।
প্রশাসনিক দুর্বলতা ও তদারকির অভাব – অনেক উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো বাস্তবায়ন হয় না বা যথাযথ মনিটরিং হয় না।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বিশেষ সুপারিশ
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: সব মৌসুমে চলাচলযোগ্য রাস্তা ও বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা দরকার।
সীমান্তে আধুনিক চেকপোস্ট ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা: বৈধ ব্যবসার সুযোগ তৈরি এবং চোরাচালান রোধের জন্য ইলেকট্রনিক নজরদারি, আধুনিক চেকপোস্ট ও প্রশিক্ষিত সীমান্ত বাহিনী প্রয়োজন।
অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষা কারিকুলাম: পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যক্রম তৈরি করা উচিত।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও চলমান মেডিকেল ইউনিট: দুর্গম এলাকায় মোবাইল ক্লিনিক বা মেডিকেল ভ্যান চালু করা যেতে পারে।
কমিউনিটি ভিত্তিক দুর্যোগ প্রস্তুতি: প্রতিটি গ্রামে দুর্যোগকালীন সাড়া-দাতা দল ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
পরিবেশ রক্ষা ও বন সংরক্ষণ: সামাজিক বনায়ন, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং এবং পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
একটি সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা (Integrated Development Master Plan) তৈরি করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পর্যটন ও পরিবেশের উন্নয়নকে একত্রিত করা।
স্থানীয় নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, যাতে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তব প্রয়োজনে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
সামাজিক ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষা: ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী ও ভাষাগত বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও সামাজিক সংহতি রক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
স্থানীয় পর্যায়ে ছোট উদ্যোগ ও স্টার্টআপকে উৎসাহ: যুবসমাজকে প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যবসায় উৎসাহিত করা উচিত।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব: উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে টেকসই করতে সরকারি ও এনজিও/প্রাইভেট সেক্টরের সমন্বয় অপরিহার্য।