বান্দরবান জেলার অভ্যুদয়

বান্দরবান জেলা, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি অনন্য অংশ। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কিংবদন্তির মিশেলে গঠিত এই জেলার অভ্যুদয় এক গভীর ঐতিহাসিক অধ্যায়। প্রাচীন শাসনের ধারাবাহিকতা, নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য এবং ব্রিটিশ আমলের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস মিলিয়ে বান্দরবানের আজকের রূপ গড়ে উঠেছে।

google news
গুগোল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

🐒 কিংবদন্তির ছায়ায় বান্দরবানের নামকরণ

বান্দরবানের নামকরণ নিয়ে একটি প্রচলিত রূপকথা আছে। জনশ্রুতি অনুসারে, একসময় এই অঞ্চলে অসংখ্য বানর বাস করত। বানরের দল পাহাড়ের ঢালে এক ছড়ার পাড়ে এসে লবণ খেতে আসত প্রতিদিন। একবার প্রবল বর্ষণের ফলে ছড়ার পানি বেড়ে যায়, ফলে বানরের দল স্বাভাবিকভাবে পার হতে না পেরে একে অপরকে ধরে ধরে সারিবদ্ধভাবে পার হয়। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে এলাকার মানুষের বিস্ময়ের অন্ত ছিল না।

এই দৃশ্য থেকেই জায়গাটির নাম হয় ম্যাঅকছি ছড়া — মারমা ভাষায়, ‘ম্যাঅক’ অর্থ বানর, আর ‘ছি’ অর্থ বাঁধ। কালের বিবর্তনে ও বাংলা ভাষাভাষীদের উচ্চারণে এটি পরিণত হয় “বান্দরবান” নামে। বর্তমানে সরকারি দলিলপত্রে বান্দরবান নামটি স্থায়ীভাবে স্বীকৃত। তবে মারমা ভাষায় এখানকার নাম এখনও রদ ক্যওচি ম্রো

🗺️ ইতিহাসের গভীরে বান্দরবান

বান্দরবান জেলার ইতিহাস বহু প্রাচীন। ১৫৫০ সালের বাংলার প্রথম মানচিত্রে এই অঞ্চল বিদ্যমান ছিল। তবে ইতিহাসবিদদের মতে, তারও প্রায় ৬০০ বছর আগে, অর্থাৎ ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে, আরাকানের রাজা এই অঞ্চলটি দখল করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে ত্রিপুরা, আরাকান, মুঘল এবং ব্রিটিশদের শাসনাধীনে আসে বান্দরবান।

⏳ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় শাসন পর্যায়:

  • ৯৫৩ খ্রিঃ: আরাকানের রাজা অঞ্চল দখল করেন

  • ১২৪০ খ্রিঃ: ত্রিপুরার রাজা কর্তৃক এলাকা দখল

  • ১৫৭৫ খ্রিঃ: আরাকান রাজা পুনরায় আক্রমণ করে কিছু অংশ দখল করেন

  • ১৬৬৬ খ্রিঃ: মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন শুরু হয়

  • ১৭৬০ খ্রিঃ: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসন শুরু করে

 

 

🏛️ ব্রিটিশ শাসন ও প্রশাসনিক পুনর্গঠন

১৮৬০ সালে বান্দরবান ব্রিটিশ ভারতের অংশ হয় এবং চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস নামে একটি প্রশাসনিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই অঞ্চল চট্টগ্রাম জেলার অধীনস্থ ছিল।

📜 চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন ১৯০০

ব্রিটিশ সরকার ১৯০০ সালে একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করে:
➡️ Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900 — যার মাধ্যমে তিনটি সার্কেল তৈরি করা হয়:

  1. চাকমা সার্কেল

  2. মং সার্কেল

  3. বোমাং সার্কেল

বান্দরবান ছিল বোমাং সার্কেল-এর অংশ। এই সার্কেলের শাসনভার দেওয়া হয় বোমাং রাজপরিবার-কে, যারা ১৬ শতক থেকেই এই অঞ্চল শাসন করে আসছিল। এই কারণে বান্দরবানের আদি নাম ছিল বোমাং থং

🧭 টাইমলাইন: বান্দরবান জেলার অভ্যুদয়ের ধারা

সালঘটনা
৯৫৩আরাকানের রাজা অঞ্চলটি দখল করেন
১২৪০ত্রিপুরার রাজা দখল করেন
১৫৫০বাংলার প্রথম মানচিত্রে বান্দরবান অন্তর্ভুক্ত
১৫৭৫আরাকান পুনরায় অঞ্চল আক্রমণ করে
১৬৬৬মুঘল শাসন শুরু
১৭৬০ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসন শুরু
১৮৬০ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্তি
১৯০০চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন কার্যকর, বোমাং সার্কেল গঠিত
১৯৫১বান্দরবান মহকুমা হিসেবে রাঙামাটির অংশ হয়
১৯৮১বান্দরবান পূর্ণাঙ্গ জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে

 

 

🌄 বান্দরবানের অভ্যুদয় কেন গুরুত্বপূর্ণ?

বান্দরবানের অভ্যুদয় কেবল একটি প্রশাসনিক ইতিহাস নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও নৃগোষ্ঠীগত চেতনার বিকাশ
এই অঞ্চলের:

  • বৈচিত্র্যময় জাতিগোষ্ঠী

  • রাজন্য শাসনের ইতিহাস

  • ব্রিটিশ উপনিবেশিক রূপরেখা

  • এবং রূপকথায় ভরপুর নামকরণের উৎস
    — সব মিলে বান্দরবান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে।

বান্দরবানের অভ্যুদয় শুধুমাত্র প্রশাসনিক রূপান্তরের গল্প নয়, বরং এটি একটি অবিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের দলিল। প্রাচীন আরাকান শাসন, ত্রিপুরার প্রভাব, মুঘল ও ব্রিটিশ কর্তৃত্ব এবং স্থানীয় রাজতন্ত্রের এক দীর্ঘ ধারাবাহিকতা আজকের বান্দরবান জেলাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ জেলাগুলোর একটিতে পরিণত করেছে।

আরও পড়ুনঃ

১ thought on “বান্দরবান জেলার অভ্যুদয়”

Leave a Comment